গাউসুল আযম হযরত বড়পীর মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিনালী (রহঃ) তার ৭ম ওয়াজে বলেছেন:
- গাউসুল অযম বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিনালী (রহঃ) বলেছেন- তুমি প্রবৃত্তির গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে যাও এবং তার অনুসরণ ও আমিত্বের ভাব বর্জন করো, বরং তোমার যাবতীয় কাজ আল্লাহর উপর ন্যস্ত করো। অতঃপর তুমি তোমার মনের দরজায় আল্লাহর তরফ থেকে প্রহরী হয়ে যাও এবং যথাযথভাবে তাঁর নির্দেশ পালন করতে থাকো। আল্লাহ পাক যে ধ্যান-ধারণা বা ভাবনা-চিন্তা গুলো তোমার মনে ঢুকাতে বলেছেন, সেগুলোকে মনে স্হান দান করো আর যে সব ধ্যান-ধারণা মন থেকে বের করে দিতে বলেছেন, সেগুলোকে তথা থেকে দ্রুত হটাও, ক্ষণকালের জন্যও ঠাঁই দিও না।
- মোটকথা, আল্লাহ পাক যে সব বিষয়বস্তু অন্তরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন, সেগুলোকে প্রবেশ করতে দিওনা এবং কিছু মনে প্রবেশ করে থাকলে তাড়িয়ে বের করে দাও। এভাবে তা বের করা কালে যেন তা তোমার মনেও ওগুলোর প্রতি এতটুকু আকর্ষন উদয় না হয় কেননা তা হলে তমি তোমার দায়িত্ব পালনে সফল হবে না। এজন্যই ঐসব বস্তুর প্রতি সদা কঠোরতা এবং বিরুদ্ধাচারণ প্রদর্শন করতে হবে। তোমাকে অবশ্যই প্রবৃত্তির চাহিদার বিরোধিতা করে আল্লাহর ইচ্ছার অনুবর্তী হতে হবে। যদি তা না হও, তবে তুমি নির্বোধদের আবাষভূমি গভীর জঙ্গলে গিয়ে পড়বে এবং তথায় তোমার অপমৃত্যু ঘটবে। এমতাবস্তায় তুমি আল্লাহর করুণা, রহমত থেকে বঞ্চিত হবে, তাঁর মঙ্গলময় দরবার থেকে বিতারিত হবে। এজন্য তোমার অবশ্য কতব্য হলো, সারাজীবন আল্লাহর আদেশ পালন এবং নিষেধ বর্জনে আপ্রাণ তৎপর থাকা। তোমার তাকদীরের নির্দ্ধারিত যাবতীয় বস্তু আল্লাহর উপর সোপর্দ করা। আল্লাহর সাথে তাঁর সৃস্ট যে কোন বস্তুকে অংশীদার না করা। তোমার যে কোন কামনা-বাসনা আল্লাহরই মখলুক (সৃস্ট)। সুতরাং অন্তরে কোন বস্তুর প্রতি কামনা বা বাসনা করা শিরকের শামিল। যদি এরুপ করো তবে তুমি মুশরিকদের অন্তর্ভূ্ক্ত হবে।
- আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দীদারে ইলাহীর আশা রাখে, তার জন্য নেক কাজ করা এবং আল্লাহর ইবাদাতে কাউকে শরীক না করা অবশ্য কর্তব্য। কেবলমাত্র মূর্তি পূজাই শিরক কার্য তা নয়, বরং প্রবৃত্তির অনুসরণ করা, দুনিয়া ও আখেরাতে এবং এতদুভয়ের কোন বস্তুকে অন্তরে স্হান দান করাও শিরকের অন্তর্গত। আল্লাহ ব্যতীত দুনিয়া ও আখেরাতে যা কিছু রয়েছে, তা সবই গায়রুল্লাহ ( অর্থাৎ আল্লাহ নয় )। সুতরাং কেউ গায়রুল্লাহর কামনা করলে তা আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকে শরীক করা হয়। এরুপ কামনা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। গায়রুল্লাহর প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে পরহেজ করবে। এমন কামনাকে ভয় করবে। এতে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে। অন্তরে এরুপ শিরকের উদ্ভব হচ্ছে না কি সর্বদা লক্ষ্য রাখবে এবং এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বণ করবে।
- এমতবস্তায় যদি তোমার মধ্যে কোন হাল বা অবস্হার সৃষ্টি হয়, তবে তাকে তোমার নিজের বলে ধারণা বা দাবী করোনা। হাল বা অবস্হার কথা কারও কাছে প্রকাশও করোনা। কেননা আল্লাহ পাক নিত্য নূতন অবস্হা সৃষ্টি করেন। দুনিয়ার অবস্থা সমূহ যখন তিনি পরিবর্তন, এবং সংকোচন করে থাকেন। এমতবস্হায় তাঁর প্রদত্ত হাল বা অবস্হাকে যদি আপন বলে ধারণা এবং প্রকাশ করো, তা হলে হয়ত সাথে সাথে তিনি তা থেকে তোমাকে বঞ্চিত করবেন। তখন তোমাকে দারুণ লজ্জায় পড়তে হবে। এজন্যই তোমার কোন হাল বা অবস্হার কথা কারও কাছে প্রকাশ না করে অন্তরে গোপন রাখাই কাম্য। তারপর যদি সেই হাল বা অবস্হা তোমার মধ্যে স্হায়ী হয়ে যায়, তা তোমার প্রতি আল্লাহর অসীম রহমত বলে মনে করবে। তখন সেই নিয়ামতের জন্য আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করার তাউফীক এনায়েতের প্রার্থনা করবে।
- আর যদি উক্ত হাল স্হায়ী না হয়ে বরং পরিবর্তন হয়ে যায়, তবে তা তোমার জন্য আল্লাহ পাকের মারেফাতের অধিকতর ইলম হাছিলের কারন বলে মনে করবে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, যদি আমি কোরআনে পাকের কোন কালাম (আয়াত) কে পরিবর্তন (রদ) করি বা ভুলিয়ে দেই তা হলে তা থেকে অধিক উত্তম তদনুরুপ অন্য কোন আয়াত নাযিল করি। ওহে তুমি কি অবগত নও যে, আল্লাহ পাক সব কিছুর উপর নিশ্চিতরুপে সামর্থ্যবান। সুতরাং তুমি আল্লাহ তায়ালাকে কোন কাজে অক্ষম বা অসমর্থ বলে মনে করো না। তুমি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের প্রতি অভিযোগ বা দোষারোপ করো না। আল্লাহর অঙ্গিকারের প্রতি সন্দেহ করো না। হযরত রাসুলে পাক (সাঃ)- এর মহান চারিত্রিক গুণাবলীর একটি গুণ তোমার মধ্যে অবশ্যই থাকা উচিৎ। তার কাছে যে আয়াত বা সুরা সমুহ অবতীর্ণ হয়, তিনি তদানুসারেই কাজ করতেন। যে আয়াতসমুহ হুজুরে পাকের মসজিদের মেহরাবের মধ্যে তিলাওয়াত করা হত, যা লিখা হয়ে যেত, তন্মধ্যকার বহু আয়াত এবং সূরা আবার পরিবর্তিত হতো এবং তদস্থলে অন্য আয়াত ও সূরা অবতীর্ণ হতো। হুজুরে পাক (সাঃ) তখন ঐ রহিতকৃত আয়াত ও সূরা বাদে অন্য আয়াত ও সূরা অনুযায়ী আমল করতেন। শরীয়তের প্রকাশ্য আনুস্ঠানিকতায় হুযুরে পাক (সাঃ) এর মধ্যে এরুপ পরিবর্তন দেখা যেত। তাছাড়া বাতেনী জগতে তাঁর এবং আল্লাহ পাকের মধ্যে যে সব রদবদলের ব্যাপার ঘটত, সে সম্বন্ধে তিনি ইরশাদ করেছেন, কখনও কখনও আমার হৃদয় অন্দরে হালকা মেঘের ন্যায় যবানিকা পড়ে যায়, এমতবস্হায় দৈনিক আমি সত্তরবার করে আল্লাহর দরবারে তওবার ইস্তেগফার করি। মতান্তরে তিনি ইরশাদ করেছেন, প্রত্যহ আমি একশবার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
- অতএব বুঝা যাচ্ছে যে, হুযুরে পাক (সাঃ) কেও বাতেনী হালত থেকে অন্য বাতেনী হালতে স্হানান্তরিত করা হতো। আবার সে দ্বিতীয় হালতও পরিবর্তিত হতো। গুপ্ত জগতের নৈকট্যের মনযিলের সব সোপান তাকে অতিক্রম করতে হতো। নূরের ভূষণে তাঁকে ভূষিত করা হতো, আবার তার পরিবর্তন ঘটত। এর দ্বারা তাঁকে ইস্তেগফার পাঠ করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা শিক্ষা দেয়া হতো। কেননা তাওবাহ- ইস্তেগফার অবস্হাটিই বান্দার জন্য সর্বোত্তম এবং শ্রেষ্ঠ হালত। অবশ্য হুযুরে পাক (সাঃ) সম্পূর্ণ মাছুম ছিলেন, তবু তাঁর জন্যও এটা সর্বোৎকৃষ্ট হাল ছিল। অনুরুপভাবে বান্দার গুনাহ হোক বা না হোক যে কোন অবস্হায় তার আল্লাহর দরবারে তওবাহ অমৃতত্তম কার্য। কেননা তওবাহর দ্বারা আল্লাহর দরবারে বান্দার অসহায়ত্ত ও দীনতা প্রকাশ পায় (এটা আল্লাহর খুবই পছন্দনীয়)।
- তওবাবাহ ও ইস্তেগফার (মুলতঃ) মানবকুলের এক মিরাছ বা উত্তরাধিকারস্বরুপ। যা আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে আমরা লাভ করেছি।তিনি গন্ধম বৃক্ষের নিকটে না যাওয়ার জন্য আল্লাহর সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন, তা ভঙ্গ করার কারনে, চিরদিন বেহেশতে থাকার লিপ্সার কারণে, তাঁর তাজীম ও সন্মান করার জন্য তাঁর কাছে সর্বদা ফিরিশতাদের অগমন কামনা করলেন, মলিন্য ও অন্ধকার এসে তাঁর হৃদয়ের ঔজ্জল্য ও স্বচ্ছতা নষ্ট করে দিলো। কেননা এসব কামনায় তাঁর মাঝে খাহেশাতে নফস প্রকাশ পেয়েছিলো এবং আল্লাহর ইচ্ছার সাথে তাঁর প্রবৃত্তির ইচ্ছা বা চাহিদার সংমিশ্রণ ঘটেছিল।যার ফলে হযরত আদমের নফস ও তাঁর কামনা দুটোই বরবাদ হয়ে গেল এবং তাঁর অন্তরে যে বেলায়েতের জ্যোতি বিরাজমান ছিল তাও দূরীভূত হলো। তখন অতি উচ্চ মর্য্দা থেকে তিনি বঞ্চিত হয়ে গেলেন। তাঁর বাতেনী তথা আভ্যন্তরীণ-নূর বিদায় নিয়ে তদস্হলে জুলমত তথা অন্ধকারের আগমন ঘটল, স্বচ্ছ-বিমলিন কলবের উপর মালিন্যের আঁধার অসন গাড়ল।
- এভাবে হযরত আদম (আ.) যখন তার অমূল্য নিয়ামত হারিয়ে চরম দুরাবস্থায় পতিত হলেন, তখন তাঁকে সাবধান ও সতর্ক করে দেয়া হলো, তাঁকে তাঁর প্রকৃত অবস্হা স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো এবং তাঁর ক্রটি ও অপরাধ স্বীকার করতঃ ক্ষমা প্রার্থনা করার অবশ্যকতার কথা জানিয়ে দেয়া আল্লাহ পাকের আদেশ লঙ্ঘনের দোষ এবং ক্ষতির ব্যাপারটি তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।তখন হযরত আদম (আ:) আল্লাহর দরবারে এভাবে আরজ করলেন যা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। হে মহান প্রতিপালক। আমি স্বীয় আত্মার উপর চরম জুলুম করেছি। আপনার নিকট মহা অপরাধে অপরাধী হয়েছি। যদি আপনি এই অপরাধ ক্ষমা না করেন এবং আমার উপর দয়া না করেন, তবে আমি ক্ষতিগ্রস্ত রুপেই থেকে যাবো। তখন আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষার বরকতে হেদায়াতের নূর, তাওবাহর রশ্মি এবং মারেফাতের জ্যোতিও তন্মধ্যস্ত নিগূঢ় ফায়েদ্যরাজি যে সম্বন্ধে তিনি ইতঃপূর্বে অবহিত ছিলেন, তাঁর মাঝে সে সব বিষয়ের আবির্ভা্ব ঘটল। যদি তখন তাঁকে তাওবার তালীম না দেয়া হতো এবং তদানুসারে তিনি তওবাহ না করতেন, তবে উল্লিখিত বস্তুনিচয় কখনও লাভ করতেন না। সারকথা আল্লাহ তখন হযরত আদম (আ.)-এর প্রতি করুণার দৃষ্টি প্রদান করলেন এবং হযরত আদম (আ.) খোদ আল্লাহর শিখানো কালাম এবং তাঁরই প্রদত্ত তাউফীকের দ্বারা আল্লাহর দরবারে তাওবাহ ইস্তেগফার করলেন।ফলকথা তখন বেহেশতে চিরজীবন থাকার যে ইচ্ছা তাঁর মাঝে নফস ও শয়তানের প্ররোচনায় সৃষ্টি হয়েছিল, তা অন্য ইচ্ছার দ্বারা পরিবর্তিত হলো এবং তিনি আল্লাহর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সোপর্দ করে দিলেন।
- যখন হযরত আদম (আ:) এভাবে স্বীয় নফসের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতঃ আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত হয়ে গেলেন, তখন পূর্ব থেকে ব্যাপক ও উচ্চতর বেলায়েতের অধিকার লাভ করলেন। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্হানে তার পরম শান্তি নছীব হলো। স্বাভাবিক কারনেই হযরত আদম (আ:) এর সন্তানদের জন্য দুনিয়া- আখেরাতের পথের ক্ষণিকের বিশ্রামাগার রুপে নির্ধারিত হয়েছে। যেখানে মানুষ ক্ষণকালীন জীবন কাটিয়ে শীঘ্রই তা পরিত্যাগ করে। অতঃপর আখেরাতের অনন্ত জীবন যাপনের জন্য তথায় চলে যায়। তবে দুনিয়ায় যারা আল্লাহর ইচ্ছা বা মর্জীর উপর নির্ভ্রর করে কালাতিপাত করে তারা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্হানে সফল জীবন যাপন করে। অতএব হে মুমিন বান্দা! তুমি লক্ষ্য কর হযরত আদম (আ:) এর তাওবাহ ও ইস্তেগফারের বাস্তব পরিনতি চিন্তা করো। তাঁর সন্তান গণের মাঝে হযরত ঈসা (আ:) মূসা (আ:) ইব্রাহীম (আ:) এমনকি সাইয়্যেদুল মুরসালীণ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মত নবী পয়দা হয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহর ইচ্ছার উপর নিজেদেরকে সোপর্দ করে বেলায়েতে কোবরা হাছিল করেছেন। এক্ষেত্রে সবাই-ই আদি পিতা হযরত আদম (আ:) এর অনুসরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে তার জ্বলন্ত প্রমাণ বিদ্যমান। সুতরাং তোমারও উচিত হযরত আদম (আ:) এর মত তওবাহ এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মত আদর্শ চরিত্র অবলম্বন করে দোজাহানের কামিয়ারী হাছিল করা। আর এটাই হলো খোদা প্রেমিক ও তাঁর বন্ধুদের প্রত্যেকের অবলম্বিত তরিকা। যা মানব জাতীর প্রকৃত মুক্তির জামিন সরুপ।